যে সকল প্রাণীর পা দুই ক্ষুর বিশিষ্ট, তাদের ক্ষুরা রোগ দেখতে পাওয়া যায়। ভেড়া, গরু, মহিষের মত ছাগলও ক্ষুরা রোগ আক্রান্ত হতে পারে। ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা, লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও কারণ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই দীর্ঘ লেখাটি।
ছাগলের ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। যখন কোনো এলাকায় কোনো গবাদি পশুর মধ্যে ক্ষুরা রোগের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়, তখন আশেপাশের অন্যান্য গবাদি পশুও ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। ক্ষুরা রোগকে সহজে প্রতিহত করা যায় না। তাই ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।
এই আর্টিকেলে যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতে চলেছি–
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের কারণ
- ছাগলের ক্ষুরা রোগ কোন বয়সে হয়?
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের লক্ষণ
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রতিকার
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রতিরোধ
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা
ছাগলের ক্ষুরা রোগের কারণ
শুরুতেই বলেছি, ছাগলের ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ নামক এক ভাইরাসের কারণে ছাগলের পাশাপাশি অন্য গবাদি পশুর এই রোগ হয়ে থাকে। ক্ষুরা রোগকে ইংরেজিতে এফএমডি নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগ সবচেয়ে বেশি বর্ষাকালে দেখা যায়।
ক্ষুরা রোগের ভাইরাসটি আক্রান্ত পশুর লালা, শ্লেষা, গোবর, প্রসাব ইত্যাদি থেকে ছড়াতে পারে। এই ভাইরাসটি এতই ছোঁয়াচে যে বাতাসের মাধ্যমেও ভাইরাস এক পশু থেকে অন্য পশুতে ছড়িয়ে যায়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, এই ভাইরাস বায়ুর মাধ্যমে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরেও পরিবাহিত হতে পারে।
যখন কোনো এলাকায় একটি পশুর মধ্যে ক্ষুরা রোগের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় তখন আশেপাশের সকল গবাদি পশুর মধ্যেও ক্ষুরা রোগের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ক্ষুরা রোগের ভাইরাস খুব সহজেই চারপাশের বাতাস দ্বারা পরিবাহিত হয়ে অন্যান্য পশুদের আক্রান্ত করে ফেলে।
ছাগলের ক্ষুরা রোগ কোন বয়সে হয়?
ছাগলের ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা একটি আক্রান্ত পশু অন্য একটি সুস্থ পশুকে সহজের সংক্রামিত করতে পারে। এই রোগটি ছাগলের বয়সের উপর নির্ভর করে না, বরং কম বয়সী ছাগল কিংবা বয়স্ক ছাগল উভয়ের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় সমান থাকে। তবে কোনো বাচ্চা ছাগল এ রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।
ছাগলের ক্ষুরা রোগের লক্ষণ
- ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ থেকে ১০৭ ফারেনহাইটের মধ্যে ওঠানামা করে।
- ছাগলের জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভেতর ফোসকা দেখা যায়।
- ছাগলের পায়ের ক্ষুরের মাঝে ফোসকা দেখা যায়।
- ছাগলের শরীরে সৃষ্ট ফোসকাগুলো পরবর্তীতে ফেটে লাল ক্ষতের সৃষ্টি করে।
- ছাগলের মুখ থেকে ক্রমাগত লালা পড়তে থাকে।
- ছাগল খুব দূর্বল হয়ে যায়।
- ক্ষুরের ফোসকা ও পায়ের ব্যথার জন্য হাটা চলা করতে অক্ষম হয়ে যায়।
- অনেক সময় রোগের পরিমাণ বেশি হলে ক্ষুরা বা জিহ্বা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
- পশুর শ্বাসকষ্ট হয় এবং রক্তশূণ্যতা দেখা যায়।
ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রতিকার
মরণব্যাধি ছোঁয়াচে ক্ষুরা রোগ থেকে প্রতিকার পেতে হলে আমাদের অবশ্যই কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া খামারিদের মধ্যে একতা না থাকলে কখনোই ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না।
ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রতিকার নিম্নে বর্ণনা করা হলো–
- যদি কোনো ছাগল কোনো কারণে আক্রান্ত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে পশুকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কেননা এতে অন্য ছাগলগুলো আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
- আক্রান্ত ছাগলটিকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।
- আক্রান্ত ছাগলকে পরিষ্কার শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে।
- কোনো অবস্থাতে আক্রান্ত ছাগলকে কাদা বা পানিতে রাখা যাবে না। এতে হিতের বিপরীত হয়ে ছাগল মারাও যেতে পারে।
- কোনো এলাকায় যদি ক্ষুরা রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে আক্রান্ত পশুকে বাহিরে নেওয়া এবং বাইরের কোনো পশুকে আক্রান্ত এলাকায় আনা উচিৎ নয়। এতে যেমন বাহিরের এলাকার পশুগুলো মহামারীর আয়ত্তায় চলে আসবে, তেমনি বাইরে থেকে আনা সুস্থ পশুও মরণঘাতী রোগটিতে আক্রান্ত হবে।
- আক্রান্ত এলাকার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল সুস্থ পশুকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
ছাগলের ক্ষুরা রোগের প্রতিরোধ
আমাদের সকলকে লক্ষ্য থাকতে হবে যেন কোনো এলাকাতেও ক্ষুরা লোকের দূর প্রভাব দেখতে না পাওয়া যায়। এজন্য আমাদের প্রয়োজন একতা। যদি সকল খামারি একসাথে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তবে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশ থেকেও ক্ষুরা রোগ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হতে পারে।
ছাগলের খুরা রোগ একটি ভাইরাসজনিত রোগ। সংক্রমণের ফলে এই ভাইরাস হাজার হাজার পশুকে আক্রান্ত করে ফেলে। আমরা যদি সতর্ক হই তবে ক্ষুরা রোগ বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করে ফেলতেও পারি। আর এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা।
যদি কোনো পশু ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত প্রশ্নটির দেহ মাটির গভীরে চাপা দিতে হবে এবং আক্রান্ত পশুর লালা, গোবর, প্রসাব ইত্যাদি খামার থেকে যত সম্ভব দূরে ফেলে আসতে হবে। কেননা এইসব উপাদানাই রয়েছে মরণঘাতী ভাইরাসটির অনুকণা।
প্রধানত আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে এলে ক্ষুরা রোগে ছাগল আক্রান্ত হতে পারে। আর উপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই ছাগলের ক্ষুরা রোগকে প্রতিহত করার একমাত্র অবলম্বন।
ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা
ছাগলের ক্ষুরা রোগের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হচ্ছে প্রতিবছর দুইবার করে ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা। এই টিকা আপনি আপনার জেলা বা উপজেলার পশুসম্পদ কেন্দ্রে পেয়ে যাবেন। এটির দাম অনেক কম, অনেক সময় বিনামূল্যেই পাওয়া যায় এবং উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তাকে বলা মাত্রই আপনাকে টিকাটি তারা প্রদান করবে।
আপনি নিজেই ছাগলকে ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের টিকাটি দিতে পারবেন। তবে মনে রাখা উচিত৷ য্ব টিকা প্রদান করলেও ছাগলের ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই নিয়মিত টিকা প্রদান করলেও আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তবে কোনো ছাগল যদি একান্তই ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হয়ে যায় তবে নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে–
- আক্রান্ত ছাগলটিকে সুস্থ ছাগল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা।
- অসুস্থ ছাগলের মাথা ও পায়ের ক্ষত পটাশ মেশানো পানি দিয়ে ধোয়া
- ফিটকিরির পানি ১০ গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে।
- সোহাগার খৈর গুড়া করে মধু মিশিয়ে মুখের ঘায়ে প্রলেপ দেওয়া
- নরম জাতীয় খাবার খাওয়ানোপশুকে
- শুষ্ক স্থানে ছাগলকে রাখা
- কোনো অবস্থাতেই কাদা মাটিতে ছাগলকে রাখা যাবে না
- খাওয়ার সোডা ৪০ গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে পায়ের ঘা পরিষ্কার করতে হবে
- পরিষ্কারকৃত পায়ের ঘায়ের উপর সালফানিলামাইড পাউডার লাগানো
- মাছি দূর করা
পৃথিবীর অনেক দেশি বর্তমানে ক্ষুরা রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। অর্থাৎ সে সব দেশে কোনো গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ হয় না। এর কারণ হচ্ছে সে সব দেশে পশুদের ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়। ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা গ্রহণের ফলে সে সকল দেশে ক্ষুরা রোগের প্রকোপ চোখে পড়ে না।
ছাগলের ক্ষুরা রোগ যেকোনো মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে। তাই যখন আশেপাশের পশু ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা পূর্বেই ক্ষুরা রোগের মহামারীর আভাস অনুমান করা সম্ভব। আর ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করলে একজন খামারি তার ছাগলগুলোর জীবন রক্ষা করতে পারবে।
ক্ষুরা রোগের লক্ষণ অনেকটা মরণঘাতী রোগের মতো হলেও যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে ছাগলকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলার সম্ভব। এর জন্য উপরে উল্লেখিত ছাগলের ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সবিস্তারে অনুসরণ করে যেতে হবে।