নিজের খামারের ছাগলগুলোর খাবার নিয়ে চিন্তিত? ভিন্ন বয়সী ছাগল পালন করে এখন ভেবে পাচ্ছেন না ছাগলগুলোর কোনটিকে কি খাওয়াবেন? তবে আর চিন্তা নয়, আমরা নিয়ে এসেছি ভিন্ন ভিন্ন বয়সী ছাগলের খাদ্য তালিকা যা আপনার খামারের ছাগলগুলোর জন্য উপযুক্ত হবে। আজকে আমরা যা যা বিষয়ে জানতে চলেছি–
- বাচ্চা ছাগলের খাবার
- বাড়ন্ত ছাগলের খাবার
- গর্ভবতী ছাগীর খাবর
- দুগ্ধবতী ছাগীর খাবার
- খাসী ছাগলের খাবার
গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে ছাগল অন্যতম একটি প্রাণী। ছাগল পালন তুলনামূলক ভাবে সহজ তাই অন্যান্য গবাদি পশুর লালন পালনের তুলনায় খামারিরা ছাগল পালনে বেশ উদ্ধুদ্ব ও আগ্রহী হোন।
বর্তমানে অনেকেই ছাগল পালনের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারছে। অনেক খামারি আবার বাণিজ্যিকভাবে ছাগলের খামার প্রতিষ্ঠা করে লাভবান হচ্ছে। বিশেষ করে কুরবানি ঈদে ছাগলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। অনেক মৌসুমী খামারি রয়েছেন যারা শুধুমাত্র ঈদকে কেন্দ্র করে ছাগল পালন করে থাকেন।
ছাগল পালনে বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনামূলক কম হওয়ায় এটি বেশ জনপ্রিয় ও কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু সঠিকভাবে ছাগল পালন ও পরিচর্যা না করলে খামারিদের আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ছাগল পালনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ছাগলের খাদ্য বন্টন ও পরিবেশন।
সঠিকভাবে খাদ্য প্রদান না করলে কোন ছাগলই সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। তাই খামারিদের উচিত বয়স ও চাহিদা অনুযায়ী ছাগলের খাবার প্রদান করা। প্রতিদিন কি পরিমান খাদ্য, কোন ধরনের ছাগলকে প্রদান করতে হবে সেই সম্পর্কে খামারিদের পূর্ব থেকে স্বচ্ছ ধারণা রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
সকল বয়সী ছাগলের খাদ্য তালিকা
সকল ধরনের ছাগলের খাদ্য তালিকা একই রকম হয় না। ছাগলের বয়সের অনুপাতে তাদের নির্ধারিত খাবারের পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। একেক ছাগলের খাদ্য তালিকা একেক রকমের হয়। তাদের প্রত্যেকের খাদ্য তালিকায় থাকে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য।
বাচ্চা ছাগলের খাবার
ছাগলের বাচ্চার প্রথম খাবার হচ্ছে শাল দুধ। জন্মের পরপরই ছাগলের ছানাকে শাল দুধ খাওয়াতে হবে। সাধারণত ছানা ছাগলকে তার ওজনের উপর ভিত্তি করে শাল দুধের পরিমাণ নির্ধারিত করতে হয়। প্রতি এক কেজি বাচ্চা ছাগলকে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম শাল দুধ খাওয়াতে হবে। দৈনিক ৮ থেকে ১০ বারের মতো এই পরিমাণ শাল দুধ প্রদান করতে হবে।
তাই খেয়াল রাখতে হবে জন্মের পর শাল দুধ প্রদান করতে খুব বেশি দেরি না হয়। যদি অতি দেরিতে কোনো বাচ্চা ছাগলকে এই শাল দুধ খাওয়ানো হয় তাহলে তার হজমে সমস্যা হতে পারে ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
অনেক মা ছাগী একসাথে একাধিক ছানা ছাগল প্রসব করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ছানা যাতে সমপরিমাণ শাল দুধ পায় সেই দিকটি সুনিশ্চিত করতে হবে। জন্মের পর সময় ও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধীরে ধীরে দুধ খাওয়ানোর পরিমাণ কমাতে হবে।
বয়স অনুযায়ী শাল দুধ খাওয়ানোর হার–
- জন্মের প্রথম দুই সপ্তাহ ২০০ গ্রাম
- পরবর্তী তিন থেকে ছয় সপ্তাহ ১৫০ গ্রাম
- সাত থেকে আট সপ্তাহ ১৩০ গ্রাম
- নয় থেকে দশ সপ্তাহে ১১০ গ্রাম
- সর্বশেষ এগারো থেকে বারো সপ্তাহে ১০০ গ্রাম
তবে ছাগল ছানা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে দুধ খাওয়া ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়। তাই পূর্ব থেকেই সামান্য পরিমাণ কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। সেই সাথে কিছু পরিমাণ দানাদার জাতীয় খাবার প্রদান করতে হবে। এই সকল দানাদার খাদ্য নির্বাচনে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নির্বাচিত খাবার গুলো উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ও কম আশের হয়ে থাকে।
দানাদার জাতীয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ডাল, তেলের খৈল,শুটকি মাছের গুড়া, ইত্যাদি। ডালের মধ্যে মাসকলাই অথবা খেসারি ভাঙ্গা দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া গমের ভুষি, চালের কুড়া, ভুট্টা ভাঙ্গা, চিটাগুড় এজাতীয় খাবার গুলো বাচ্চা ছাগলকে খাওয়ানো হয়। ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট ও ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স ছাগল ছানার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
উপরিক্ত দানাদার খাদ্যগুলো সঠিক অনুপাতে মিশ্রণ করে পরিবেশন করতে হবে। সাধারণত কোনো ছাগল ছানার বয়স যখন এক মাসের মত হয়ে যায় তখন থেকে ছাগল ছানার পাকস্থলী বিভিন্ন রকমের ঘাস হজম করার উপযোগী হয়ে ওঠে।
ছাগল ছানা এই সময়ে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত কাঁচা ঘাস বা গাছের পাতা খেতে পারে ও সঠিকভাবে হজম করতে পারে। তাই এই সময়ে উক্ত খাবার নিয়মিত প্রদানের মাধ্যমে আঁশযুক্ত খাবার হজম করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
বাড়ন্ত ছাগলের খাবার
বাড়ন্ত ছাগলের খাদ্য তালিকাও ছাগলের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একটি ছাগল এই সময়ে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার পুষ্টি ও শক্তি পায়। যদি যথাযথভাবে খাদ্য প্রদান না করা হয় তাহলে ছাগলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ছাগলটি অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। এই সময়ে ছাগল প্রজননের জন্য ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে উঠে। তাই এই সময়ে প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে দিতে হবে।
এই সময়ে ছাগলকে তার ওজনের উপর ভিত্তি করে খাবার নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত ওজনের প্রায় চার থেকে পাঁচ শতাংশ হারে শুষ্ক জাতীয় খাবার একটি ছাগল খেয়ে থাকে।
ছাগলের ওজন যদি চার কেজি হয় তাহলে দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে ১০০ গ্রাম, সেই সাথে ০.৪ কেজি ঘাস জাতীয় খাবার দিতে হবে।
ছয় বছর বয়সী ছাগলের জন্য ২০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য ও ০.৬ কেজি ঘাস; আট বছর বয়সের ছাগলে জন্য ২০০ গ্রাম দানাদার পদার্থ ও ০.৮ কেজি ঘাস জাতীয় খাবার সরবরাহ করতে হবে।
পাতার মধ্যে ৫০% লিগুম পাতা দেওয়া যেতে পারে। লিগুম পাতার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস, যা একটি ছাগলের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করবে। দানাদার খাদ্য যদি বেশি পরিমাণে দেওয়া হয় তাহলে তার সাথে অবশ্যই এক পারসেন্ট অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহৃত করতে হবে। অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করলে প্রস্রাবের রাস্তার পাথর হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না।
গর্ভবতী ছাগলের খাবার
ছাগল খামারিদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো একটি ছাগলের গর্ভবতী অবস্থা ও গর্ভবতীর ছাগলের পরিচর্যা ও যত্ন। ছাগল গর্ভবতী হলে সেই সময়ে তার আলাদাভাবে বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অনেকেই জানেন না কিভাবে একটি গর্ভবতী ছাগলের পরিচর্যা নিতে হয়।
একটি গর্ভবতী ছাগলের খাদ্য চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। এই সময় ছাগলের পুষ্টিগুণ অন্তত তিনগুণ বেশি দরকার পড়ে। তাই তার খাদ্য নির্ধারণের সময়ে যাচাই করে খাদ্য প্রদান করতে হবে। এই সময়ের প্রাপ্ত পুষ্টির উপরেই নির্ভর করে গর্ভে থাকা ছাগল ছানার সুস্থতা ও দৈহিক বৃদ্ধি।
এই সময়ে খামারির উচিত ছাগলকে তুলনামূলক নরম খাদ্য প্রদান করা। যাতে গলদঃকরন ও হজমে সমস্যা না হয়। খাবারগুলো যাতে সতেজ থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই সময়ে ছাগলের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিনের প্রয়োজন হয়। ভিটামিনের অভাবের কারণে কোন জটিলতা যাতে সৃষ্টি না হতে পারে, সেজন্য নিয়মিত ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে।
গর্ভধারণের শেষ সপ্তাহে গর্ভের বাচ্চার দেহের দুই তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি ঘটে। সেজন্য এই সময়ে প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন বেশি পরিমাণে দিতে হবে সেই সাথে ভাতের মাড় ও খড় জাতীয় খাবারও প্রদান করতে হবে।
দুগ্ধবতী ছাগলের খাবার
গর্ভবতী থাকাকালীন একটি ছাগলের খাদ্য তালিকা যেরকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বাচ্চা প্রসব হওয়ার পরবর্তী সময়েও ছাগলের খাদ্য তালিকা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বাচ্চা প্রসব হওয়ার পর থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময়কে দুগ্ধকালীন সময় বলে। যদি গর্ভ অবস্থায় ছাগলকে সঠিক পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করা হয় তাহলে বাচ্চা হওয়ার পর থেকে ছাগী পর্যাপ্ত দুধ উৎপন্ন করতে পারে।
পূর্বে যে পরিমাণ দানাদার জাতীয় খাবার মা ছাগীকে দেওয়া হয়েছিল সেটি পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর আস্তে আস্তে এই দানাদার জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং ১০ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ দানাদার খাবার বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
খাসী ছাগলের খাবার
খাসির খাবারের দিকেও সমপরিমাণ যত্নবান হওয়া উচিত। খাসির ওজন সাধারণত তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। তাই খাসিকে দানাদার জাতীয় খাবার প্রদান করতে হবে। এ দানাদার জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বয়সের ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
এই জাতীয় খাবার খাসির ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে ঘাস জাতীয় খাবারের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে হবে। তবে অবশ্যই অধিক পরিমাণে দানাদার খাবারের সাথে খুবই অল্প পরিমাণ অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করতে হবে।
আমাদের প্রদত্ত ছাগলের খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে আপনার ছাগলকে খাবার দিন ও ছাগলে সুস্বাস্থ্যতা নিশ্চিত করুন।
thanks for this information