ছাগলের জন্য ঘাস নিয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন

আমাদের দেশে গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম হলো ছাগল। ছাগল পালন, পরিচর্যা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা অন্যান্য গৃহপালিত প্রানীদের থেকে তুলনামূলক সহজ। ছাগলের প্রধান খাদ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঘাস। আজ থাকছে ছাগলের জন্য ঘাস নিয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন।

ছাগল সাধারণত সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য বা আঁশ জাতীয় খাবার খুব সহজেই হজম করতে পারে। ছাগল নিয়মিত মতো বিভিন্ন ধরনের ঘাস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেলুলোজ সহ অন্যান্য অত্যাবশকীয় উপাদানের ঘাটতি পূরণ করে।

ঘাস ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা ও দানাদার জাতীয় পদার্থ ছাগলকে প্রদান করা হয়। তবে একটি ছাগল প্রায় সারাদিনই ঘাস খেতে পারে। ছাগলকে প্রায় আট থেকে নয় ঘণ্টা ঘাস খাওয়ালে দানাদার খাবারে খরচ অনেক কম হয় যা সব খামারির জন্য লাভজনক।

বিভিন্ন রকমের ঘাস

ছাগলের জন্ম পর থেকে প্রথমে অল্প পরিমাণে ও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রকমের ঘাস খাওয়ানো অভ্যস্ত করতে হবে। ছাগল খামারিরা ছাগলের খাদ্য ব্যবস্থা সহজ ও সুষ্ঠ করার জন্য নিজেরাই বিভিন্ন রকমের ঘাসের আবাদ বা চাষ করতে পারে।

ছাগলের খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতাও ব্যবহার করা হয়। এই সকল ঘাস, লতাপাতা ছাগলের দৈনিক পুষ্টিগুণ চাহিদা সহজে পূর্ণ করে।

এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘাস হচ্ছে পাকচুং, নেপিয়ার COCN 4, জার্মান, প্যারা, লুসার্ণ ইত্যাদি।

গাছের পাতার মধ্যে বয়েছে কাঁঠাল পাতা, তুতগাছের পাতা ইত্যাদি। ছাগল কাঁঠাল পাতা খেতে অনেক পছন্দ করে। কাঠাল ছাগলের জন্য কাঁঠাল পাতা খুব উপকারী। তাই বলা হয়, “ছাগলের কাছে কাঁঠাল পাতাই দুনিয়া।”

এই সকল ঘাস এবং পাতার গুনাগুন সম্পর্কে ছাগল খামারিদের পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের ঘাসের গুনাগুন

১. নেপিয়া ঘাস

ছাগলের জন্য নেপিয়ার ঘাস খুবই উপর্যুক্ত একটি ঘাস। এর রাসায়নিক নাম নেপিয়ার সিওসিএন ফোর। যদিও বিভিন্ন ধরনের নেপিয়ার ঘাস পাওয়া যায় কিন্তু সবগুলো প্রজাতি ছাগলের জন্য উত্তম নয়। ছাগলের খাদ্য হিসেবে যে প্রজাতিটি সর্বোৎকৃষ্ট তার নামই হচ্ছে COCN 4।

লাল বর্ণের এই ঘাস বছরের প্রায় সবসময় চাষ করা যায় ও ভালো ফলন হয় হয়ে থাকে। ফলে খামারিরা সহজেই ছাগলের জন্য ঘাসের যোগান দিতে পারে।

এছাড়া নেপিয়ার পাকচং এক নামক একটি ঘাস রয়েছে। এটি উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি ঘাস।

এই ঘাসটি গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য খুবই উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অন্যান্য উপাদানের সাথে পাকচং ঘাসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। প্রায় ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ প্রোটিন এই পাকচং ঘাস থেকে পাওয়া যায়।

একবার এই উদ্ভিদ রোপন করলে টানা ৮ থেকে ১০ বছরের মত খামারিরা এর ফলন পেয়ে থাকে। এটি একটি উচ্চ উৎপাদনযোগ্য ঘাস এবং বছরে মোটামুটি ছয় থেকে আট বার নিয়ম করে এই ঘাস কাটতে হয়।

পাকচং ১ ঘাসের ফলন এতই ভালো যে শুধুমাত্র এই ঘাস চাষ করেই বছরে ১৮০ থেকে ২০০ মেট্রিক টন সবুজ ঘাস কৃষক ও খামারীরা উৎপাদন করে  লাভবান হতে পারে।

এছাড়া আরো অনেক হাইব্রিড নেপিয়া ঘাস রয়েছে কিন্তু সেই সকল ঘাস গ্রহণের প্রতি ছাগলের খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না।

২. হেজ লুসার্ণ ঘাস

হেজ লুসার্ণ নামে আরো একটি ঘাস ছাগলকে খাওয়ানো হয়। এই ঘাসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। প্রায় প্রায় ৩৪ শতাংশ প্রোটিন এই লুসার্ণ ঘাসের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ছাগলের প্রোটিন চাহিদা পূরণের জন্য খামারিরা তাদের নিজস্ব ফার্মে এই ঘাসের চাষ করতে পারেন।

এই ঘাসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি একবার রোপন করলে পরবর্তীতে পুনরায় আর রোপন করার প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণত এই ঘাসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বীজ হয় এই সকল বীজ যদি কোন স্থানে পড়ে তাহলে সেখানে সহজেই প্রাকৃতিক নিয়মে নতুন চারার সৃষ্টি হয়।

ছাগলের নিকট এই গাছটি খুবই পছন্দনীয়। কেননা, এই জাতীয় ঘাস হজমে ছাগলের কোনরকম অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। খামারিরা সাধারণত তাদের জমির আশেপাশেই এই ঘাসের আবাদ করে থাকে।

৩. গ্লিরিসিডিয়া ঘাস

গ্লিরিসিডিয়া নামক গাছটি ছাগলের জন্য খুবই উপাদেয় একটি উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ থেকে যেমন প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। সেই সাথে পাওয়া যায় ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং বিভিন্ন ধরনের নিউট্রিশন।

এই সকল উপাদান গুলো ছাগলের দৈহিক বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব প্রয়োজন। গ্লিরিসিডিয়া থেকে খুব সহজেই এই সকল উপাদান ছাগল খাবার গ্রহণের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। তাই খামারিরা গোটারি ফার্মে এই ধরনের উদ্ভিদের চাষ করে থাকে।

এই উদ্ভিদের বীজ সঠিক স্থানে স্থাপন করে পাঁচ দিনের মতো অপেক্ষা করলেই সেখান থেকে অংকুরোদগোম সৃষ্টি হয় এবং দ্রুত বেড়ে ওঠে ও ফলন বেশ ভালো হয়। তাই খামারিদের উচিত এই উদ্ভিদের গুনাগুন সম্পর্কে আরো বেশি করে অবগত হওয়া এবং ছাগলের ফার্মের জন্য উপযুক্ত পরিবেশে এর চাষ করা।

৪. জাম্বু ঘাস

ঘাসের মধ্যে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘাস হচ্ছে জাম্বো ঘাস। এটি সাধারণত সব ধরনের মাটিতেই উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু বেলে মাটিতে জাম্বো ঘাস চাষ করা যায় না।

জাম্বো গাছের জন্য আদর্শ মাটি হলো দোআঁশ মাটি ও এটেল মাটি। যদিও সারা বছরে এই ঘাস চাষ করা যায়। তথাপি যখন বা যেই স্থানে অল্প পরিমাণের বৃষ্টি হয় তখন এই ঘাসের ফলন ভালো হয়।

এই ঘাসের মধ্যে রয়েছে ৯ থেকে ১৮% প্রোটিন। এই ঘাস গবাদিপশুকে সরবরাহ করলে প্রাণির দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং খামারিরা খুব সহজেই লাভবান হতে পারে।

ছাগলের জন্য ঘাস ফলানোর স্থান

ছাগলের জন্য ঘাস চাষের তুলনামূলক উচু জমি বেশ গ্রহনীয়। কেননা উচু জমিতে সহজে পানি জমতে পারে না। ছাগলের জন্য স্যাতস্যাতে পরিবেশ অনেকটাই ক্ষতিকর। তাই উঁচু জমিতে ছাগল চড়াতে হবে।

সাধারণত সেখানেই পাকচং ও জাম্বু নামক এই কাচা ঘাসের ফলন বেশ ভালো হয়, তাই সহজেই ছাগল তার খাদ্য গ্রহণ করতে পারে।

ছাগলের খাদ্য পরিবেশন

ছাগল শক্ত খাবার খেতে পছন্দ করলেও তাকে ঘাস খাওয়ানোর সময় ঘাস্কে কুচি কুচি করে কেটে পরিবেশন করলে ভালো হয়। ছাগল সেগুলো ছিঁড়ে খেতে পছন্দ করে এবং খুব সহজে হজম করতে পারে। এই ছাড়া ঘাসের সাথে কিছু পরিমাণ পানি মিশিয়ে দিয়ে ছাগলকে খাওয়ানো যায়।

হাইড্রোপনিক চাষ

ছাগল পালনের আরেকটি সুবিধাজনক ঘাস চাষ হচ্ছে হাইড্রোপনিক ঘাস চাষ। সাধারণত শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণের মাঠ বা জমি না থাকায় ছাগল চড়ানোর সুযোগ সেভাবে পাওয়া যায় না। তাই অনেকেই বাড়ির ছাদকে ছাগল পালনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।

যে পদ্ধতিতে মাটি ও জমি ছাড়াই ঘাস উৎপাদন করা হয় সেই পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক চাষ বলে। এই পদ্ধতি খুব একটা ব্যয়বহুল না হওয়ার প্রায় সব ধরনের খামারিরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন করতে পারে।

ঘরের ছাদে অথবা ভেতরে, বারান্দায়, মাটির পাতিলে, পানির বোতলে বীজ রোপন করে এই ঘাস উৎপাদন করা যায়।

কখন ঘাস খাওয়াতে হবে

ছাগলের বয়সের পার্থক্যের সাথে খাবারের তারতম্য দেখা যায়। ছাগল ছানার জন্মের পর তার হজম ক্রিয়া খুব একটা স্বাভাবিক থাকে না। তাই আশ জাতীয় খাবার তখন খুব একটা দেওয়া যাবে না। তবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘাস খাওয়ানোর পরিমান বাড়াতে হবে।

বিশেষ করে গর্ববতী ছাগলকে বেশি পরিমাণের ঘাস, লতাপাতা খাওয়াতে হবে কেননা সেই সময়ে ছাগলের পুষ্টির চাহিদা অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় তিন থেকে চার গুন বেশি থাকে। 

তো কেমন লাগলো আমাদের ছাগলের জন্য ঘাস নিয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন। আশা করছি এই আর্টিকেলটি পড়ার পর ছাগলের জন্য ঘাসের সকল ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবেই পরিচালনা করতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *