ছাগলের নিউমোনিয়া রোগ – কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

ছাগলের-নিউমোনিয়া-goat-pneumonia

গৃহপালিত প্রাণী বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে একটি হলো নিউমোনিয়া। ছাগলের নিউমোনিয়া রোগ রোগ বলতে মূলত ফুসফুসের প্রদাহকে এবং ব্রংকিওলের সমস্যাকে বুঝায়। আজ আমরা জানবো ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে।

আজকের লেখাটিতে যা যা জানতে চলেছি–

  • ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের কারণ
  • ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ
  • ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসা
  • ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
  • ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের প্রতিরোধ

ছাগলের নিউমেনিয়া রোগ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানা উচিত ঠিক কি কি কারণে এই রোগটি হতে পারে। সাধারণত শীতকালে ছাগলসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এক পরিসংখ্যান হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের হার প্রায় ৮.৭৭ শতাংশ।

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের কারণ

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগ সাধারণত একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। তবে এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাস বা ভাইরাসের সংক্রমনেও এই রোগ হতে দেখা যায়। নিউমোনিয়া রোগের জীবাণুর নাম স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি।

আবার অনেক ক্ষেত্রে অসাবধনতাবশত খাবার, পানি বা ওষুধ জাতীয় কোনো পদার্থ শ্বাসনালীতে ঢুকে গেলে নিউমোনিয়া হতে পারে। এই ধরনের নিউমোনিয়াকে ফলে এস্পাইরেশন নিউমোনিয়া। পূর্বেই বলা হয়েছে শীতকালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকলেও ছাগলের এই রোগটির হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে  দীর্ঘ সময় ধরে ছাগলদের ভেজা অবস্থায় থাকতে হয়। যার কারণে অতিরিক্ত ঠান্ডা লেগে এই নিউমোনিয়া রোগটি হয়ে থাকে। এছাড়া আক্রান্ত ছাগলের সংস্পর্শে থাকলেও অন্যান্য ছাগলদের এই রোগটি হতে পারে।

এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছাগলদের স্থানান্তর করলে পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণেও নিউমোনিয়া রোগের সৃষ্টি হতে পারে। বদ্ধ পরিবেশ বা পর্যাপ্ত আলো বাতাস না থাকলেও অনেক গবাদি পশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগ হতে পারে।

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগ এর লক্ষণ

নিউমোনিয়া রোগ এ আক্রান্ত ছাগল
© aces.edu

কোনো রোগের লক্ষণ সঠিকভাবে জানা না থাকলে রোগের প্রকৃতি নির্ধারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। স্পষ্ট ধারণার অভাবে খামারিরা সঠিকভাবে ছাগলের পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় অবস্থা এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে যে ছাগলের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ সম্পর্কে খামারি ও মালিকদের অবগত থাকা প্রয়োজন।

  • নিউমোনিয়া রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হল হালকা জ্বর ও একটু পর পরই ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেওয়া।
  • অনেক সময় জ্বরের পরিমাণ ১০৪ ডিগ্রি থেকে ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
  • ঘন ঘন কাশি দেওয়া এই রোগের আরোও একটি লক্ষণ।
  • যেহেতু নিউমোনিয়া একটি ঠান্ডা জনিত রোগ তাই প্রায় সময় দেখা যায় আক্রান্ত ছাগলের নাক থেকে ক্রমাগত সর্দি ঝরতে থাকে এবং তাদের নাক বন্ধ থাকে। এই অবস্থায় তাদের নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
  • ছাগলের নাক দিয়ে পানি ঝরবে সেই সাথে নাকে ময়লা জমে থাকবে।
  • ছাগলের নাকের উপরের নরম মাংসপেশী উঠানামা করবে।
  • ছাগলের বুকের কাছে ঘড়ঘড় শব্দ করবে বা বাঁশির মত আওয়াজ শোনা যাবে।
  • ছাগল ঠিকমত খাবার খাবে না এবং স্বাভাবিক যেমন আচরন করা দরকার তেমন করবে না।
  • ঝিম মেরে চুপচাপ একপাশে দাড়িয়ে বা বসে থাকবে।
  • এই সময়ে ছাগলদের মধ্যে ক্ষুধা মন্দার লক্ষণ দেখা যায় এবং তারা সহজে কিছু খেতে চায় না। খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার ফলে অতি দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়।
নিউমোনিয়া রোগ এ আক্রান্ত ছাগল
© aces.edu

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসা

ছাগলের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিলম্ব না করে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। নিউমোনিয়া রোগের ধরন ও প্রকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধের মধ্যেও ভিন্নতা দেখা যায়, যেমন–

  1. ভাইরাসের কারণে যে নিউমোনিয়া রোগ সংঘটিত হয় তাকে বলে ভাইরাল নিউমোনিয়া। যদি এর মাত্রা খুব একটা প্রকট না হয় তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণত ভাইরাল নিউমোনিয়ার ইলেক্ট্রোলাইটস, তরল এবং প্রদাহ বিরোধী এজেন্টগুলির সংমিশ্রণে অ্যান্টিহিস্টামিন ঔষধ ব্যবহার করে চিকিৎসা করা হয়।
  2. পরজীবের সংক্রমণের ফলেও নিউমোনিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে Ivermectin এবং Albendazole 2 ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে একটি ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে যে, গর্ভাবস্থায় কোন প্রাণীকে এলবেন্ডাজল প্রদান করা যাবে না।
  3. নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ থেকে জানা যায় এই সময়ে ছাগল খাবার গ্রহণ করা সাধারণত বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিকারের জন্য ডেক্সটো ২৫%, ২০ মিলি, B-1 বা থায়ামিন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই ওষুধ গ্রহণের ফলে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ছাগলের খাবার হজম করতে সাহায্য করে। যার ফলে ছাগল পুনরায় খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ ফিরে পায়।
  4. ছাগলের নিউমোনিয়ার রোগ হলে প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসকরা অনেক সময় কিছু এন্টিবায়োটিক ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এন্টিবায়োটিক ওষুধ গুলোর কিছু পরিচিত নাম হলো Tylo Pc Gold, Nuflon LA-200, Penicillin, Renamycin LA ইত্যাদি। নিউমোনিয়া রোগের উৎপত্তি যদি ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে হয়ে থাকে তবে এই এন্টিবায়োটিক গুলো খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
  5. প্রাথমিক অবস্থায় ছাগলের সর্দি বা ঠান্ডা লাগলে মক্সিলিন ভেট ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ সরাসরি মুখে খাওয়ার মাধ্যমে গ্রহণ করা যায়। আবার ইনজেকশনের মাধ্যমেও প্রদান করা যায়। মক্সিলিন ভেট ছাড়াও সিপ্রো এ ভেট নামক ওষুধ ব্যবহার করা যায়।

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের ঔষধ

[ বিশেষভাবে দ্রষ্টব্যঃ যে কোন ওষুধ খওয়ানোর আগে বা টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই রেজিস্টার্ড প্রাণী চিকিৎসকের বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিপদের সময় দ্রুত সেবা পেতে প্রাণী চিকিৎসকের বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার মোবাইল নাম্বার আপনার কাছে অবশ্যই রাখবেন ]

1. Asta – Vet (100 ml) Injection – ছাগলের ওজন হিসেবে প্রতি ১০ কেজির জন্য ১ মিলি. করে গভীর মাংসপেশীতে প্রয়োগ করতে হবে।। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে দিতে হবে। এভাবে তিন দিন দিতে হবে।

ASTA-VET (Pheniramine Meleate)
© ACME Laboratories Ltd

2. Pronapen 40 Lac Injection (vet) – ছাগলের ওজন হিসেবে প্রতি ১০ কেজির জন্য ১ মিলি. করে গভীর মাংসপেশীতে দিতে হবে। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে দিতে হবে। এভাবে তিন দিন দিতে হবে।

ঔষধের নামপরিমাণপ্রয়োগ
Asta – Vet (100 ml) Injection১ মিলি প্রতি ১০ কেজি ওজনের জন্যগভীর মাংসপেশীতে
Pronapen 40 Lac Injection (vet)১ মিলি প্রতি ১০ কেজি ওজনের জন্যগভীর মাংসপেশীতে

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

ছাগলের সর্দি-কাশি বা নিউমোনিয়া রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পেলে শুরুতেই চিকিৎসকের সাহায্য অনেক সময় পাওয়া না যেতে পারে। সেই সময়ে বেশ কিছু ঘরোয়া পদ্ধতির মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও নিরাময় পাওয়া সম্ভব।

ঘরোয়া পদ্ধতির একটি অন্যতম উপাদান হলো সরিষা তেল। আক্রান্ত ছাগলের নাকে সরিষার তেল ব্যবহার করলে খুব সহজেই ঠান্ডা থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।

এছাড়া আদা, তুলসী পাতা কালাজিরা, বাসকপাতা এই সকল ভেষজ উপাদানের সংমিশ্রণ ছাগলকে প্রদান করা হলে ছাগলের ইমিউনিটির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ঘরোয়া পদ্ধতি নিয়মিত প্রদান করতে হয়।

ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের প্রতিরোধ

যেকোনো রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সেই রোগের ঝুঁকির মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। ছাগলের নিউমোনিয়া রোগ যেভাবে প্রতিরোধ করা যায় তার নিম্নে উল্লেখ করা হলো–

  • যেহেতু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এই রোগের একটি অন্যতম কারণ তাই ছাগলের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনোভাবে ঘরে ময়লা পানি জমতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
  • ছাগলের আবাসস্থল এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে আলো বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত মাধ্যম ও সুবিধা থাকে।
  • ছাগলকে স্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করে খাদ্য প্রদান করতে হবে।
  • সাধারণত ছাগলকে নিচ তলায় বা মাটির খুব কাছাকাছি রাখলে খুব সহজেই ঠান্ডা লেগে যায়। তাই এই সমস্যা দূর করার জন্য ছাগলকে মাটি থেকে তিন ফুট উপরে একটি স্থানে বসাতে হবে।
  • যদি কোন ছাগল আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে সেটিকে আলাদাস্থানে নিয়ে বিশেষ পরিচর্যা করতে হবে এবং অন্য ছাগলের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে সেদিকে বিশেষ সতর্ক রাখতে হবে।

ছাগলের নিউমোনিয়া নিয়ে খুবই একটি সাধারন রোগ। সঠিক সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ রোগ থেকে গবাদি পশুকে খুব সহজেই সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তাই ছাগলের নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসা জেনে রাখা ভালো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *