ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ

বর্তমানে অনেক তরুণ চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে গ্রামে খামার তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এখন কৃষিকাজ কিংবা গৃহপালিত পশু যেমন: গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পালন করে মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। বাজারে চাহিদা বিবেচনা করে অনেকেই ছাগল পালন করা শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব ও নানাবিধ কারণে ছাগল পালনে নবীন খামারিরা লাভবান হচ্ছেন না। ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ নিয়ে আজকে আমি আলোচনা করতে চলেছি।

ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ

গরুর তুলনায় বাংলাদেশের খামারিরা ছাগল পালনে বেশি আগ্রহী। এর পেছনে কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণও রয়েছে। ছাগল পালনের জন্য বেশি বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। অপরদিকে গরু পালনের জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া ছাগল পালনের ক্ষেত্রে শারীরিক শ্রম তুলনামূলক কম। ছাগল অত্যন্ত শান্ত প্রাণী হওয়ায় ছাগলের পেছনে বেশি সময়ও ব্যয় করতে হয় না।

শুনতে ছাগল পালন খুবই সহজ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে অভিজ্ঞতা ও পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে ছাগল পালনে আপনি বড় রকম ধরাও খেয়ে যেতে পারেন। এদিকে আপনার ইনভেস্ট করা টাকা উঠে আসা তো দূরে থাক বড় রকম ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে।

আর ছাগল পালনে আপনার ক্ষতি যাতে না হয় তার জন্য ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ নিয়ে এই লেখাটিতে আলোচনা করতে চলেছি। আশা করছি, এই আলোচনাটির পর আপনি ছাগলের খামারে আরো বেশি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবেন এবং ভবিষ্যতে আসা বাধাগুলোকে পার করতে সক্ষম হবেন।

১. ছাগলের রোগে আক্রান্ত হওয়া

ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ছাগলের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা। ছাগল একটি নিম্ন শ্রেণীর জীব। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য জীবের তুলনায় অনেক কম।

ছাগল অসময়ে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ বাঁধিয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে আতঙ্কজনক তথ্যটি হচ্ছে যে ছাগল বেশিরভাগ ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। ছোঁয়াচে রোগ এমন রোগ যেগুলোতে একটি ছাগল আক্রান্ত হলে খামারের বাকি ছাগলগুলোও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় খামারে যখন একটি ছাগল রোগে আক্রান্ত হয় তখন অন্যান্য ছাগলগুলো খুব দ্রুতই আক্রান্ত হয়ে যায়। আবার বেশির ভাগ ছোঁয়াচে রোগ মরণঘাতি হওয়ার কারণে খামারে প্রত্যেকটি ছাগল মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে যায়। সঠিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে খামারে প্রত্যেকটি ছাগলই মারা যেতে পারে।

আর যদি এমন কিছু হয়, সেক্ষেত্রে খামারির বড় রকম লস হয়ে যাবে। কারণ তার অতি আদরের প্রত্যেকটি ছাগলই তাকে হারাতে হচ্ছে। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। সর্বদা সতর্ক থাকলে ছাগলের ছোঁয়াচে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভব।

যদি কোনো ছাগলের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় সেক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আক্রান্ত ছাগলটিকে সুস্থ ছাগলদের থেকে একেবারে আলাদা করে রাখতে হবে। এতে বাকি ছাগলগুলো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আবার অসুস্থ ছাগলকে একজন পশু চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসা নিলে অসুস্থ ছাগলটিকে সুস্থ করে তোলাও সম্ভব।

২. ভুল ছাগলের জাত নির্বাচন

বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করা হয়। যাদের মধ্যে দেশি-বিদেশি উভয়ে ছাগল রয়েছে। আমরা অনেকে দেশি ছাগল পালন করতে যাই। কিন্তু দেশী ছাগল বছরে মাত্র দুইবারের কম করে বাচ্চা দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না।

অপরদিকে একটি বিদেশি ছাগল বছরে দুইবার করে বাচ্চা দেয়। মোটামুটি ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে একবার করে বাচ্চা দিতে দেখা দেয়। কিন্তু কোনো কোনো ছাগলের জাত রয়েছে যাদের বাচ্চা দেওয়ার হার তুলনামূলক কম। এইরকম ছাগলের জাত নির্বাচন করলে আপনি খামারের বড় ধরনের ক্ষতির মুখেও পড়তে পারেন।

তাই ছাগলের জাত নির্বাচন করার পূর্বে অবশ্যই ভাবা উচিত। এমন ছাগলের জাত খামারে পালন করা উচিত যাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার হার অন্যান্য ছাগলের তুলনায় বেশি। এক্ষেত্রে বিদেশি ছাগল নির্বাচন করা যেতে পারে। কারণ এদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার হার তুলনামূলক বেশি এবং খুব দ্রুতই এরা বড় হয়ে ওঠে।

৩. জায়গার অভাব

ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে যদি আমরা জায়গার অভাবের কারণটিকে না উল্লেখ করি! অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় খুবই স্বল্প একটি জায়গায় আমরা অনেকগুলো ছাগলকে ধরে রাখি অথবা আমাদের খামারের আকার খুবই ছোট অথচ ছাগলের সংখ্যা অনেক বেশি।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এমনটা করলে আমাদেরই লাভ। কেননা কম জমিতে বেশি ছাগল চাষ করলে স্পষ্টই লাভ হবার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে লাভের আশা করা বোকামি। কেননা কম জায়গায় বেশি ছাগল পালন করলে ছাগলগুলোর ছোঁয়াচে রোগ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়।

এমনকি ছাগলের প্রস্রাব বা মল যখন মেঝেতে পড়ে থাকে, তখন সেখান থেকেও নানা রকম রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। এতে ছাগলের অসুস্থতার হার বেড়ে যায়। মূলকথা হচ্ছে ছোট একটি জায়গায় অনেকগুলো ছাগল যখন রাখা হয় তখন একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সৃষ্টি হয়, যা খামারে লসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৪. অভিজ্ঞদের পরামর্শ না শোনা 

অনেকেই এমন আছেন যারা পূর্বেও হাতে গোনা কয়েকটি ছাগল পালন করেছেন। তারা অতি উৎসুক হয়ে একটি খামার গড়ে তুলে এবং বহু সংখ্যক ছাগল নিয়ে পালন করাও শুরু করে দেয়। কিন্তু তারা অভিজ্ঞ খামারিদের পরামর্শ শুনতে চায় না। এটিও খামারে লস হওয়ার অন্যতম কারণ।

কেননা কয়েকটি ছাগল পালন করা এবং একটি খামারে অনেকগুলো ছাগল পালন করার মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। অনেকগুলো ছাগল একসাথে পালন করা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। বিভিন্ন কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কেউ যদি এগুলোর কথা চিন্তা ভাবনা না করেই নিজে নিজেই ছাগল পালন করার কথা ভাবে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় রকম লস খাবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

বিশেষ করে অনেকেই শুধুমাত্র ইউটিউব ভিডিও দেখেই খামার দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করে। তাদের এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

৫. ছাগলের খাবার

আমরা কয়েকটি ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ জেনেছি। এবার জেনে নেই সবচেয়ে বড় কারণটি। আমরা যখন একটি ছাগলে খামার দিই তখন শুরু থেকেই আমাদের ছাগলের খাবার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় ছাগলের খাবারের মূল্য বাজারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাজারে ছাগলের দাম কেমন একটা বাড়ে না। এতেই আমাদের খামারিরা বড় রকম লসের দিকে ধাবিত হয়।

বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই ব্যবহার্য পণ্যের দাম ওঠানামা করে। এটি নতুন কোনো বিষয়ও নয়। আবার অনেকেই মনে করেন ছাগলকে শুধু বিভিন্ন রকম খড়, গাছের পাতা, ভাতের মাড় ইত্যাদি খাওয়ালেই যথেষ্ট। কিন্তু একটি ছাগলের খামারে ছাগলের জন্য এসব খাদ্য মোটে উপযুক্ত খাদ্য নয়।

একজন খামারির প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে ছাগলকে মোটাতাজা করা। আর এর জন্য আপনাকে ছাগলের খাবারে প্রোটিনের হার সর্বোচ্চ রাখতে হবে। প্রোটিন যুক্ত খাবারগুলো আবার বাজার থেকে কিনতে হয়।

যদি বাজারে খাবারের দাম বেশি উঠে এবং ছাগলের দাম নিচে যায় সেক্ষেত্রে বড় রকম ধরা খেয়ে যেতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি খাবারের কিন্তু বিকল্প রয়েছে। তাই বাজারে অবস্থা বুঝে বিকল্প খাবারের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।

উপরে ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ জানানোর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে আপনি একটি ছাগলের খামার দিলে ভুলেও লস না করে বসেন। যদি আপনি ছাগলের খামার দিয়ে লাভবান হতে চান সেক্ষেত্রে উপরের কারণগুলো মাথায় রেখে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ছাগলের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত, পর্যাপ্ত খাবার ব্যবস্থা, স্থান সংকুলন ও উন্নত জাতের ছাগল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ছাগলের খামারে লস হওয়ার কারণ সমূহ শুধু জেনে নিলেই হবে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। ছাগলের খামারে লস হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরা হয় বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের কারণে ছাগলের মৃত্যু। তাই আপনার ছাগলকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং প্রতিনিয়ত ছাগলের পরিচর্যা করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *