গর্ভপাতের পর ছাগলের যে রোগটি কমবেশি দেখা যায় সেটি হচ্ছে ওলান পাকা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে ছাগলের পাশাপাশি খামারিকেও নিদারুণ কষ্ট ভোগতে হয়। ছাগল ওলান পাকা রোগে আক্রান্ত হলে খুব সহজেই রোগটি চিহ্নিত করা সম্ভব। ছাগলের ওলান পাকা রোগের চিকিৎসা, কারণ, বয়স, রোগের লক্ষণ, রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে এবার জানতে চলেছি।
আজকের এই আর্টিকেলে যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতে চলেছি–
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের কারণ
- ছাগলের ওলান পাকা রোগ কোন বয়সে হয়?
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের লক্ষণ
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের প্রতিকার
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের প্রতিরোধ
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের চিকিৎসা
- ছাগলের ওলান পাকা রোগের ঘরোয়া চিকিৎসাঃ
ছাগলের ওলান পাকা রোগের কারণঃ
ছাগলের ওলান পাকা রোগ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। শুধু একটি ব্যাকটেরিয়া নয় বরং এ রোগের পিছনে প্রায় বিশটির মতো ব্যাকটেরিয়ার হাত রয়েছে। ওলান পাকা রোগ ছাগলের পাশাপাশি গরু, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি পশুর হয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়া জনিত এ রোগটি কিন্তু ছোঁয়াচে রোগ। অর্থাৎ একটি পশু থেকে আরেকটি পশুতেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
ছাগলের ওলান পাকা রোগ কোন বয়সে হয়?
ছাগলের পোলান পাকা রোগটি কোন বয়স ভিত্তিক রোগ নয়। বরং গর্ভপাতের পরেই ছাগল এ রোগে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ গর্ভবতী নয় এমন কোনো ছাগল এ রোগে আক্রান্ত হয় না। আবার পুরুষ ছাগলের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মূলত স্ত্রী ছাগলের রোগের এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

ছাগলের ওলান পাকা রোগের লক্ষণঃ
- কোন ছাগল ওলান পাকা রোগে আক্রান্ত হলে এদের ওলান ফুলে যায়, শক্ত হয়ে যায় এবং টকটকে লাল বর্ণে ধারণ করে।
- এই রোগে আক্রান্ত হলে ছাগলের ওলানে খুব যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। ফলে ছাগলটির ক্রমাগত চিল্লাতে থাকে।
- ওলান এবং বাটে অনেক ব্যথা হয় ফলে ছাগী বাচ্চাদের দুধ খেতে দেয় না।
- দুধ খাওয়াতে গেলেই ছাগলটি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
- এছাড়া ওলান পাকা ছাগলের দুধের মান অত্যন্ত নিম্নতর এবং অনেক পাতলা হয়ে যায়।
- অনেক সময় ছাগলের দুধে রক্ত কিংবা পুজ বের হতে পারে।
- ওলান পাকা রোগে আক্রান্ত ছাগলের দুধে খেতে অত্যন্ত কটু ও লবণাক্ত এবং উৎপাদন কমে যায়।
- দুধ কিছুক্ষণ রেখে দিলেন নিচে তলানি দেখতে পাওয়া যায়। এই তলানি অনেক সময় রক্ত বা পুঁজের কারণে হয়ে থাকে।
- ছাগলের গাঁয়ে জ্বর আসে এবং নাড়ির গতি অনেক বেশি বেড়ে যায়।
- ছাগীর ওলানে ব্যাথা থাকার করনে শুতে পারে না এবং দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থাকে।
ছাগলের ওলান পাকা রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা / নিয়ন্ত্রণ করার উপায়ঃ
- ছাগীকে মুক্ত ভাবে থাকতে দিতে হবে, অল্প জায়গার মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা যাবে না।
- ছাগীর বাচ্চা হওয়ার আগে ও পরে সমান এবং নরম জায়গায় রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে জায়গাটি যেন অবশ্যই পরিষ্কার ও পরিছন্ন হয়।
- ছাগল ছানা একটু রড় হয়ে গেলে খেয়াল রাখতে হবে দুধ পান করার সময় যেন ছাগীর ওলান বাচ্চার দাঁত দিয়ে কেটে না যায়।
- ছাগীর বাচ্চা গুলোকে বাট চুষে দুধ খেতে না দিয়ে আলাদাভাবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
- দুধ দহনকারীকে সব সময় পরিস্কার-পরিছন্ন থাকতে হবে।
ছাগলের ওলান পাকা রোগের প্রতিকারঃ
দুর্ভাগ্যবশত ছাগলের ওলান পাকা রোগের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তাই খামারির ছাগল যাতে এ রোগে আক্রান্ত না হয় সেদিকেই যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবত গর্ভাবস্থায় ছাগলের প্রতি বাড়তি নজরদারি দিতে হবে। ছাগল কি খাচ্ছে, অন্যান্য ছাগলের সাথে মেলামেশা করছে কিনা এসব দিক লক্ষ্য রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ বা সাবধানতা অবলম্বন না করলে ছাগী মারা যেতে পারে।
- ওলান পাকা রোগে আক্রান্ত ছাগীকে আলাদা করে রাখতে হবে।
- আক্রান্ত ছাগী যেখানে রাখা হবে, সেই স্থান পরিস্কার ও পরিছন্ন রাখতে হবে।
- ছাগীর ক্ষত দেখা গেলে, ক্ষত স্থানে সাথে সাথে পরিস্কার করতে হবে।
- ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস রোগে আক্রাত ছাগীর বাচ্চাদের জন্য আলাদা ভাবে দুধের ব্যবস্থা করতে হবে।
- যদি কোন ভাবে বাচ্চার দাঁত দিয়ে ছাগীর বাট কেটে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই যায়গা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এবং পশু চিকিৎসক এর পরামর্শ মত কাজ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
[ বিশেষভাবে দ্রষ্টব্যঃ যে কোন ওষুধ খওয়ানোর আগে বা টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই রেজিস্টার্ড প্রাণী চিকিৎসকের বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিপদের সময় দ্রুত সেবা পেতে প্রাণী চিকিৎসকের বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার মোবাইল নাম্বার আপনার কাছে অবশ্যই রাখবেন ]
ছাগলের ওলান পাকা রোগের চিকিৎসাঃ
ছাগলের ওলান পাকা রোগের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকলেও একবার যদি ছাগল এ রোগে আক্রান্ত হয় তবে যথেষ্ট সেবা যত্ন করলে কিন্তু ছাগল খুব দ্রুতই এই রোগ থেকে কাটিয়ে ওঠে এবং পুনরায় ওলান স্বাভাবিক হয়ে যায়। যদি কোনো ছাগল ছাগলের ওলান পেকে যায় সেক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে যাতে ছাগলের ওলানগুলো কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
এছাড়া নিয়মিত ঠান্ডা পানি দিয়ে আলতো করে ওলান দুটো ধুয়ে দিতে পারেন। এছাড়া বাচ্চা যখন মা ছাগলের দুধ পান করতে যাবে তখন সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনেক সময় বাচ্চা দুধ পান করতে যাওয়ার সময় মা ছাগলের ওলানে আঘাত লাগতে পারে।
এছাড়া চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ওলান পাকা রোগে আক্রান্ত ছাগলের দুধ পান করা মোটে উচিত নয়। এসব দুধে রক্ত বা পুঁজ ইত্যাদি থাকে, যা খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
এ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে নিচে দেয়া হলঃ-
- প্রথমেই আক্রাত ছাগীকে আলাদা স্থানে রাখতে হবে।
- প্রতিদিন ছাগলের ওলান থেকে দুই থেকে তিনবার দুধ বের করে ফেলতে হবে এবং আয়োডিনযুক্ত পানি দিয়ে ওলান ধুয়ে দিতে হবে।
- আয়োডিন দ্রবণ এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।
- এমপিসিলিন ৩ মিলিগ্রাম ইনজেকশন আক্রাত ছাগীকে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- এমপিসিলিন ইনজেকশন পাশে কিটোপ্রোফেন ১.৪ মিলিগ্রাম ইনজেকশন ৩৬-৪৮ ঘণ্টা পর ছাগলের শিরায় দিলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠে।
- ছাগীর ওলানের দুধ বের করে বাটে নিচের যেকোনো ১টি ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
(ক) টেরামাইসিন
(খ) পেনিসিলিন
(গ) এম্পিসিলিন
(ঘ) সালফানোমাইডম
(ঙ) মেসিডেট
(চ) ফ্লোরটেরাসাইক্রিন
ছাগলের ওলান পাকা রোগের ঘরোয়া চিকিৎসাঃ
ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস রোগটি ছাগলের হলে প্রথমে ছাগলকে আলাদা করতে হবে। ছাগী বাচ্চা দেয়ার পর সমতল ও নরম জায়গায় ছাগীকে রাখতে হবে।
ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস রোগটি ছাগলের জন্য মারত্মক ব্যাধি। সাবধানতা অবলম্বন না করলে ছাগলের মারত্মক ক্ষতি হতে পারে।। তাই ছাগীকে পশুচিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে , ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস রোগটির বিরুধে যথা-সময়ে চিকিৎসা এবং ব্যবস্থা নিলে এ রোগ থেকে সুফল পাওয়া যাবে। আর মনে রাখতে চিকিৎসা নিতে দেরি হলে ছাগীর দুধ উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং ছাগীর মৃতু ঘটতে পারে।
ছাগলের গর্ভাবস্থায় খামারি সতর্ক না থাকলে মা ছাগল ওলান রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে দুশ্চিন্তার কোনো কিছু নেই। ছাগলের ওলান পাকা রোগের চিকিৎসা বিদ্যমান সঠিক পন্থা অবলম্বন করলে ছাগল দ্রুতই ওলান রোগ থেকে সরে উঠতে পারবে।
তাই শেষ কথা পশুচিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহনেই রোগ থেকে মুক্তির উত্তম উপায়।