ইদানিং অনেকেই গ্রামাঞ্চলে ছাগলের খামার দিচ্ছেন। ছাগলের খামার দিতে পুঁজি লাগে কম, স্থানও লাগে কম। আবার সামান্য অভিজ্ঞতা থাকলেই ছাগলে খামার দিয়ে লাভ উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব।
বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে তরুণরা, ছাগলের খামার দিচ্ছেন। ছাগলের খামার দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য দুধ উৎপাদন কিংবা মাংস, অথবা উভয়ে হতে পারে। এর পাশাপাশি কেউ কেউ চামড়ার জন্যেও ছাগল পালন করে থাকেন। উদ্দেশ্য যাই হোক, ছাগল পালন করতে হলে আপনার অবশ্যই প্রয়োজন অভিজ্ঞদের পরামর্শ এবং ছাগল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা।
আপাত দৃষ্টিতে ছাগলের খামার দেওয়া খুব সহজ একটি কাজ মনে হতে পারে। ছাগলের বাসস্থানের জন্য জায়গা লাগে কম। খাবারও লাগে কম। ছাগলের আকার ছোট হওয়ায় ছাগল পালন করাও খুব একটা পরিশ্রমের কাজ মনে হয় না। তারপরেও ছাগলের খামার করার আগে যা জানতে হবে।
ছাগলের খামার করতে চাইলে এই তথ্যগুলো জানা থাকা দরকার
উপযুক্ত ছাগলের জাত নির্বাচন
একটি ছাগলের খামার দিতে হলে সবার আগে আপনাকে ছাগলের জাত নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন রকম ছাগলের জাত বাংলাদেশে পালন করা হয়। ছাগলের জাত নির্বাচন করার পূর্বে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি উদ্দেশ্যে আপনি ছাগল পালন করতে চান।
আপনার উদ্দেশ্য যদি ছাগলের দুধ বিক্রি করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ছাগলের জাত হবে আলাদা। আবার আপনার উদ্দেশ্য যদি ছাগলের ছাগল বিক্রি করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও ছাগলে জাত হবে পূর্ব থেকে একেবারে ভিন্ন।
আবার আপনার উদ্দেশ্য দুগ্ধ উৎপাদন কিংবা মাংস বিক্রি দুটোই হলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছাগল পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ছাগলের জাত হচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। এই ছাগলের চামড়া বাজারে অত্যন্ত উঁচু মানের হিসেবে কদর আছে।
এছাড়া এই ছাগল পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ প্রদান করে। যদিও ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের আকার মাঝারি হয়ে থাকে। তবুও একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ছাগলের ওজন ২০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
তবে মাংসের উদ্দেশ্যে যদি কেউ ছাগল পালন করতে চান সেক্ষেত্রে রাম ছাগল হতে পারে সবচেয়ে উপযুক্ত। রাম ছাগলের ওজন ৪০ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এই ছাগল ও পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ প্রদান করে। যদিও রাম ছাগলের দুধ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মতো সুমিষ্ট নয়। ইতিমধ্যেই আমরা ছাগলের জাত নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছি
কম সংখ্যক ছাগল দিয়ে খামারের যাত্রা করা
আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন একটি ছাগলের খামার দিবেন সেক্ষেত্রে আপনার উচিত কম সংখ্যক ছাগল নিয়ে একটি খামারের যাত্রা করা। অনেকেই শুরুতে একশ বা দেড়শ ছাগল দিয়ে খামার শুরু করেন। এটি মোটেও করা উচিত নয়।
শুরুতে ১২ থেকে ২০ টি ছাগল নিয়ে একটি খামার দেওয়া যেতে পারে। একটি ছাগলের খামার পরিচালনা করতে প্রয়োজন পূর্ব অভিজ্ঞতা। বেশি সংখ্যক ছাগল নিয়ন্ত্রণে রাখাও কঠিন। শুরুতে কম সংখ্যক ছাগল দিয়ে খামার গড়ার পর আস্তে আস্তে যখন লাভের মুখ দেখবেন, তখন ছাগলের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
ছাগলের খাবার

আমরা অনেকেই জানি, ছাগল একটি তৃণভোজী প্রাণী। যা ঘাস কিংবা বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু আপনি যখন একটি খামার দিয়েছেন এবং আপনার খামার দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাগলের মাংস কিংবা ছাগলের দুধ উৎপাদন করা সেক্ষেত্রে ঘাস কিংবা গাছের পাতার উপর নির্ভর করলে চলবে না।
ছাগলকে দিতে হবে ভুট্টা গুড়া, সয়াবিন খৈল, চিটা গুড়, গমের ভুষি ইত্যাদি। এগুলো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। এই খাবার খেলে ছাগল দ্রুত মোটাতাজা হবে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি করে দুধ প্রদান করবে। যা আপনার ব্যবসায় লাভবান করতে সহায়তা করবে।
ছাগলের খামারে প্রতিদিন ভাতের মাড়, খেসারি, তুষ ইত্যাদি খাদ্য দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া খামারে পরিষ্কার পানি পানির ব্যবস্থাও করতে হবে।
কিন্তু তাই বলে এই নয় যে ছাগলকে ঘাস খাওয়া কিংবা গাছের পাতা খাওয়া থেকে বিরত রাখবেন। যদি সম্ভব হয় ছাগলকে নিয়মিত খোলা মাঠে চরাতে হবে এবং এখান থেকেই তারা ঘাস ও অন্যান্য গাছের পাতা খেতে পারবে।
ছাগলের রোগ সম্পর্কে পূর্ব ধারণা রাখা
আমরা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হই। ঠিক তেমনি ছাগলও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যদিও মানুষের মতো ছাগলের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। ফলস্বরূপ ছাগল সহজে বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং সামান্য রোগেই মারাও যেতে পারে। ছাগলের প্রধান প্রধান রোগগুলো হল –
তাই আমাদের পূর্ব থেকেই ছাগলকে বিভিন্ন রকম রোগ হতে রক্ষা করার টিকা প্রদান করতে হবে। একটি ছাগলের বয়স যখন চার থেকে ছয় মাস হয় তখন থেকেই বিভিন্ন টিকা দেওয়া উচিত।
যেহেতু ছাগলের বেশির ভাগ রোগী ছোঁয়াচে রোগ, তাই কোনো ছাগলের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেই সেটিকে দ্রুত আলাদা করে রাখতে হবে। আমাদের ওয়েবসাইটে ছাগলের বিভিন্ন রকম টিকা নিয়ে একটি আর্টিকেল ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া ছাগল যেসব রোগে আক্রান্ত হয় সেসব রোগের বিস্তারিত ও চিকিৎসা সম্পর্কেও আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছি। আর্টিকেলগুলো পড়ে আপনার খামারের ছাগলগুলোর জন্য উপযুক্ত টিকাগুলো আজই নিকটস্থ উপজেলা পশু সম্পদ কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করে আনুন এবং ছাগলের উপর প্রয়োগ করুন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই টিকাগুলো যদি না দেন সে ক্ষেত্রে খামারের উপর কিরকম প্রভাব পড়তে পারে? উত্তর হচ্ছে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। আগেই বলেছি ছাগল যেসব রোগে আক্রান্ত হয় তার বেশিরভাগই ছোঁয়াচে রোগ। এই ছোঁয়াচে রোগ খামারের একটি ছাগলকে আক্রান্ত করলে বাকি ছাগলগুলোকেও খুব সহজে আক্রান্ত করে ফেলে।
আর ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু খুবই কম তাই পুরো খামারের ছাগলগুলোর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এতে রাতারাতি বড় রকম লস খাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
ছাগলের বেশির ভাগ রোগ মরণঘাতী এবং এদের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। একমাত্র পূর্ব থেকেই যদি রোগ প্রতিরোধের টিকার দেওয়া হয় সেক্ষেত্রেই ছাগলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
ছাগলের বাসস্থান

অনেকেই মনে করেন ছাগল পালনের জন্য বড় পরিসরে জায়গার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে এই ধারণা ভুল। কয়েকটি ছাগলের জন্যও হলেও আপনাকে বড় পরিসরে খামার বাড়ানো উচিত।
কেননা ছোট পরিসরে খামার বানালে ছাগলগুলো নিজেদের মধ্যে রোগ জীবাণু বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। এছাড়া ছোট খামার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করে যা ছাগল পালনের জন্য মোটে উপযুক্ত নয়।
আমাদের দেশে হুট করেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়। কখনো খুব গরম পড়ে, আবার কখনো খুবই ঠান্ডা পড়ে যায়। আবার কখনো তো ঝড় বৃষ্টিরও দেখা মেলে। আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত কারণে ছাগলগুলোকে যাতে ভোগতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
গরমের দিনে খামারের ভেতর ফ্যানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার শীতকালে ছাগলের শরীরে চাদর বা বস্তা জাতীয় জিনিস পড়িয়ে উষ্ণতা প্রদান করা যেতে পারে। আর ঝড় বৃষ্টিতে যাতে খামারের ভেতর পানি কিংবা ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
তবে মনে রাখতে হবে খামারের ভেতর যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করার পথ থাকে। এছাড়া খামারের মেঝে যেন পানি কিংবা ছাগলের প্রসাবে স্যাতসেতে না হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রেও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
একটি ছাগলের খামার করতে চাইলে এই তথ্যগুলো জানা থাকা দরকার। নতুবা একটি ছাগলের খামার দিতে গিয়ে শুরুতেই বিনিয়োগ করা সম্পূর্ণ টাকা লস খেয়ে যেতে পারেন। তাই ছাগলের খামার দিয়ে লাভবান হতে চাইলে আমাদের দেওয়া উপরের পরামর্শগুলো গ্রহণ করার করতে পারেন।
আমি একটা খামার দিতে চাই